জাল হাদিস কি?
যে কথাটি বা হাদিসটি মানুষ নিজে তৈরি করেছে, তারপর সেটা মহানবি ( সাঃ) নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই জাল হাদিস নামে পরিচিত। অর্থাৎ সহিহ হাদিস-এর বিপরিত।
জাল হাদিস
সত্যিকার অর্থে এগুলা হাদিস নয়। তবে মানুষ হাদিস হিসেবে জানে অর্থাৎ প্রচলিত হাদিস। তাহলে আমরা বলতে পারি, যে বাক্য মহানবি সাঃ এর কথা, কাজ নয় যা ত্রুটিপুর্ন, যার নির্ভরযোগ্য সনদ নেই তাই জাল হাদিস।
ইমাম ইবনে সালাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “ মনগড়া এবং বানোয়াট হাদিসকে মাওযু বলা হয়।” রেফারেন্স-মুকাদ্দামায়ে ইবনে সালাহ : পৃ. ৭৭
জাল হাদিসসের উৎপত্তিঃ
চল্লিশ হিজরী সাল ছিল সুন্নাতের বিশুদ্ধতার মধ্যে মিথ্যার অনুপ্রবেশ ও জাল হাদীস রচনার সময়কাল। এরপর সহিহ সুন্নতে চললো সংযোজন ও বিয়োজন; সুন্নতকে তৈরি করা হলো রাজনৈতিক সার্থ গ্রহনের হাতিয়ার এবং অভ্যন্তরীন ভাবে মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যম।
অর্থাৎ হিজরী চল্লিশ সন পর্যন্ত সুন্নত ছিল সহিহ। তারপর হযরত আলী ( রাঃ ) ও হযরত মুয়াবিয়া ( রাঃ ) এর মধ্যকার কোন এক বিরোধের কারনে যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করলো। প্রচুর রক্ত ক্ষয় হলো , প্রাণ হারালো অনেক লোক , মুসলমানরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়লো ।
অধিকাংশ লোকই ছিলো হযরত আলী ( রাঃ ) এর পক্ষে এবং মুয়াবিয়া ( রাঃ ) এর বিপক্ষে। তারপর উত্থান হলো খারিজীদের। প্রথমে তারা ছিল হযরত আলী ( রাঃ ) এর ঘনিষ্ঠ সমর্থক।
তারপর তারা হযরত আলী ( রাঃ ) ও মুয়াবিয়া ( রাঃ ) উভয়কে বর্জন করলো এবং দোষারোপ করতে লাগলো।
হযরত আলী ( রাঃ ) এর মৃত্যু এবং মুয়াবিয়া ( রাঃ ) এর খিলাফত গ্রহণের পর পর আল-ই-বায়ত খিলাফত তাদের প্রাপ্য বলে দাবী করতে লাগলো। তারা উমাইয়্যা বংশের আনুগত্য স্বীকার করলো না। এ রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে মুসলমানগণ বহু বড় ও ছোট দলে আলাদা হয়ে পড়লো। প্রত্যেক দলই নিজ দলের পক্ষে কুর’আন ও হাদীসকে দাঁড়া করাতে লাগলো।
তবে এটা সত্য কথা যে , প্রতিটি দলই যা দাবী করবে , তার পক্ষে কুর’আন ও সুন্নত থাকবে না। এবং কোন কোন দল কুর’আনের সথিক অর্থকে বাদ দিয়ে বিকৃত ব্যাখ্যা শুরু করে দিল। আর সুন্নত যে অর্থ বহন করে , তা গ্রহণ না করে ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করতে লাগলো।
তাদের মধ্যে এমনও কিছু দল ছিল , যারা তাদের দলীয় সমর্থনে রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) এর নামে হাদীস ব্যাখ্যা শুরু করলো। তাদের পক্ষে খুবই কঠিন হলো কুর’আনের বেলায় অনুরূপ কিছু করার ; কারণ কুর’আন অতি সুরক্ষিত। মুসলমানদের অন্তরে অন্তরে কুর’আন , কমবেশি সকলের মুখে মুখে তিলাওয়াত। এখান থেকেই সূচনা হলো জাল হাদীস রচনার এবং বিশুদ্ধ সাথে হাদীসের সাথে জাল হাদীসের সংমিশ্রণ।
বানোয়াট বা জাল হাদীস রচনাকারীরা প্রথমে বিভিন্ন ব্যক্তির ফযীলত সম্পর্কে গোপন পথ রচনা করল। তারা তাদের দল ও উপদলের শীর্ষস্থানীয় লোকদের এবং ইমামদের ফযীলত সম্পর্কে বহু জাল হাদীস রচনা করলো ।
ধারণা করা হয় ‘ শিয়ারাই প্রথমে এই জাল হাদিসের সূত্রপাত ঘটায় । ’ ইবনে আব্দুল হাদীদ ‘ শরহে নাহজুল বালাগাহ তে একই কথা লিখেছেন—“ তোমরা শুনে রেখ , ফযীলত সম্পর্কে যত মিথ্যা/জাল হাদীস রচিত হয়েছে, এর মূল হলো শিয়ারা ।”
ইরাক হলো জাল হাদীস রচনার ভান্ডার। হাদীসের ইমামগণও এর প্রতি কথা বলেছেন । ইমাম যুহরী ( রঃ ) বলেছেনঃ
“ আমাদের নিকট হতে হাদীস বের হয়ে যেত এক বিঘত পরিমান তারপর ইরাক হতে আমাদের নিকট ফিরে আসত এক হাত পরিমান ।”
আমরা জাল হাদিস যেভাবে বুঝতে পারবোঃ
১। নির্ভরযোগ্যতা কম।
২। ভাল স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেনি।
৩। জাল হাদিসের সনদ দুর্বল।
৪। গভির বিশ্লেষণ করলে ত্রুটি পাওয়া যায়।
৫। এই হাদিস অধিকতর নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর বর্ণনার বিরোধী।
হাদিস কি?
মহানবি সাঃ এর কথা কাজ এবং কোন কাজের প্রতি তার মৌন সম্মতিকে হাদিস বলা হয়।
আমরা সহিহ হাদিস যেভাবে বুঝতে পারবোঃ
১। নির্ভরযোগ্যতা সম্পন্ন বাক্য।
২। ভাল স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন।
৩। হাদিসের সনদ পরস্পর সম্পৃক্ত।
৪। গভির বিশ্লেষণ করলে ত্রুটি পাওয়া যায় না।
৫। এই হাদিস অধিকতর নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর বর্ণনার বিরোধী নয়।
সহিহ হাদিস কি?
যে হাদিসটি নির্ভরযোগ্যতা আছে এবং স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন, হাদিসের সনদ পরস্পর সম্পৃক্ত, তার মধ্যে কোনো ত্রুটি নেই এবং যে হাদিস অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর বর্ণনার বিরোধীও নয়- তাকেই সহিহ হাদিস বলে।
সহিহ হাদিস এবং জাল হাদিস না চেনার কারন কি?
১।অজ্ঞতাঃ
আমাদের মধ্যে সহিহ হাদিস গ্রন্থ পড়ার প্রবণতা কম। আসলে কম বললেও ভুল হবে আমরা পড়ি না। আমদের এই অজ্ঞতার কারনে কিছু বক্তা আমাদের মধ্যে ভুল কিছু তথ্য ওয়াজ মাহফিলে উপস্থাপন করে।
কয়েকটি সহিহ হাদিসের গ্রন্থ এর নামঃ
সহিহ হাদিস গ্রন্থগুলো হলো- ১। সহিহ বুখারি, ২। সহিহ মুসলিম, ৩। সুনানে তিরমিজি, ৪। সুনানে আবু দাউদ, ৫। সুনানে নাসাঈ এবং ৬। সুনানে ইবনে মাজাহ। এই ছয়টি গ্রন্থকে একত্রে সিহাহ সিত্তা বলা হয়।
এ ছাড়াও আরও কয়েকটি প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ আছে যেমন- মুসনাদে আহমাদ, মুয়াত্তা মালেক, দারাকুতনি, সুনানে দারেমি ও সুনানে বায়হাকি।
ইদানিং কিছু সহিহ গ্রন্থেও জাল হাদিস এবং বিদআত ধুকিয়ে দেয়া হয়েছে। সন্দেহজনক কোন হাদিস পেলে অবশ্যই কোন সহিহ তরিকার আলেমের সরনাপন্য হওয়া।
২। ভাল বক্তার বক্তব্য না শোনাঃ
সহিহ হাদিস যারা বর্ননা করে তাদের ওয়াজ বা বক্তব্য শোনা এবং অনুধাবন মত লোক খুবই কম। এতে করে কিছুটা জীবনে চলার মত হলেও সহিহ হাদিস জানা সম্ভব।
কয়েকজন বক্তার নাম যারা সহিহ হাদিস থেকে বক্তব্য দেয়ঃ
নিচের বর্নিত বক্তার বক্তব্য কিংবা তাদের লিখা কোন বই পড়লে ইন-শা-আল্লাহ পথভ্রষ্ট হবেনা।
১। মিজানুর রহমান আজহারি।
২। কাজি ইব্রাহিম।
৩। আবু তোহা আদনান।
৪। আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর।
৫। আহমাদুল্লাহ।
৬। আমির হামজা।
৭। দেলোয়া হোসেন সাইদি।
৮। শায়েখ মুস্তাফিজ রাহমানি।
৯। আব্দুল হাই মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।
১০। আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ।
১১। মুফতী হাবিবুল্লাহ মাহমুদ ক্বাসেমী।
১২। আবুদুল্লাহ বিন ইউসুফ।
এবং
১৩। ডক্টর জাকির নায়েক।
জাল হাদিস বলা কি ধরনের গুনাহঃ
যেহেতু জাল হাদিস সাধারন মানুষের তৈরি যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে মনগড়া-বানানো মিথ্যা হাদিস বানিয়ে প্রচার ও প্রসার করা জঘন্যতম অপরাধ; যা কবিরা গুনাহের শামিল।
কারণ, রাসূলুল্লাহ সাঃ কে নিয়ে যে মিথ্যা হাদিস বানিয়ে প্রচার ও প্রসার করে , যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো জাহান্নাম।
রাসূলুল্লাহ সাঃ নিজে এ প্রসঙ্গে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি স্বেচ্ছায় মিথ্যারোপ করে, সে যেন নিজেই জাহান্নামে তার স্থান বানিয়ে নেয়। ’রেফারেন্স –সহিহ বুখারি : ১/৩১৭
প্রচলিত কিছু জাল হাদিসঃ
১। দ্বীন বা ধর্ম হচ্ছে মানুষের বিবেক, যার কোন বিবেক নেই তাঁর দ্বীন বা ধর্ম নেই ।
২। যে ব্যাক্তি আসরের পর ঘুমিয়ে পরবে, ঐ ব্যক্তির জ্ঞান ছিনিয়ে নেয়া হবে। এর কারনে সে নিজেকেই দোষারোপ করবে।
৩। মসজিদের মধ্যে কথাবার্তা পুণ্য আমলগুলোকে খেয়ে ফেলে যেমনিভাবে চতুষ্পদ জন্তু ঘাস খেয়ে ফেলে।
৪। যে ব্যাক্তির সালাত তাঁকে অসৎ কাজ হতে বিরত রাখে না, আল্লাহর নিকট হতে তাঁর দূরত্ব ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৫। পুরুষদের ইচ্ছা বা মনোবল পর্বতমালাকেও দূরে সরাতে পারে।
Ref: hadithbd.com, somewhereinblog.net, banglanews24.com